‘শাশ্বতী’ কবিতায় কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত প্রেম ও নিসর্গ চেতনা
‘শাশ্বতী’
আধুনিক কবিদের মধ্যে কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত একাধিক কারণে বিশিষ্ট। তাঁর জীবনদর্শন, কাব্যানুভূতি এবং প্রকাশধর্ম সর্বক্ষেত্রেই একটি স্বাতন্ত্র্য লক্ষ্য করা যায়। বুদ্ধদেব বসুর ভাষায়—‘সুধীন্দ্রনাথের তনু-তন্ময়তার সঙ্গে মিলেছে তাঁর অভিজাতিক সুমিতি, ইন্দ্রিয়ের ইন্দ্রলোক তাঁর দুর্লভ মননশীলতায় গম্ভীর।’ অনেকে কবি মধুসূদনের সঙ্গে সুধীন্দ্রনাথের তুলনা করেন। কিন্তু এ তুলনা সর্বক্ষেত্রে গ্রহণীয় নয়। কারণ মধুসূদন এপিক কবি আর সুধীন্দ্রনাথ একান্তভাবেই লিরিক কবি। তাছাড়া মধুসূদনের কবিতা বক্তব্যধর্মী আর সুধীন্দ্রনাথ ব্যঞ্জনাধর্মী।
যাই হোক সুধীন্দ্রনাথ তথাকথিত রোমান্টিক কবি ছিলেন না। রোমান্টিক কাব্যের অতীন্দ্রিয়তা, ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা, অতি তরল শিথিল কাব্য প্রকরণের বিরুদ্ধে তাঁর বিদ্রোহ স্পষ। এককথায় বলা যায়, প্রতীকী কবিদের সংহত ব্যঞ্জনাধর্মী স্বল্পভাষ ছিল তাঁর কাব্যাদর্শ।
সুধীন্দ্রনাথের প্রেম চেতনা প্রচলিত প্রেমাদর্শ থেকে ভিন্ন। রবীন্দ্রনাথ যেখানে প্রেমের ঐশ্বর্য রূপ দেখেছেন—প্রেমের মধ্যে পেয়েছেন পূর্ণতার স্বাদ, সুধীন্দ্রনাথ সেখানে প্রেমের মধ্যে শূন্যতা ছাড়া আর কিছুই দেখেননি। প্রেমের স্থায়িত্বেও তাঁর বিশ্বাস ছিল না। মিলনের মধ্যেও সুধীন্দ্রনাথ পূর্ণতার স্নিগ্ধ অনুভূতি পান না। তাঁর দৃষ্টিতে শাশ্বত প্রেমের সন্ধান নিষ্ফল। তাই কবির কাছে প্রেম ক্ষণবিলাস মাত্র। অন্য একটি কবিতায় সুধীন্দ্রনাথ বলেছেন—
অসম্ভব প্রিয়তমে অসম্ভব শাশ্বত স্মরণ;
অসঙ্গত চির প্রেম; সংবরণ, অসাধ্য, অন্যায়। (মহাসত্য)
সমালোচক বুদ্ধদেব বসুর মতে—‘সুধীন্দ্রনাথের গম্ভীর ও জটিল রচনাভঙ্গির সঙ্গে এই ভঙ্গুর দেহ নির্ভর প্রেমের একটি অসংগতি আছে।’
সুধীন্দ্রনাথের প্রেম-দর্শন বিচারে ‘শাশ্বতী’ কবিতাটিতে উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম বললেও হয়তো ভুল হয় না। এই কবিতাটিতে পরবর্তীকালের ক্ষণবাদী বিশ্বাসের বীজ নিহিত আছে। ‘শাশ্বতী’, ‘প্রতিদান’ এর মতো কয়েকটি কবিতায় প্রেমের প্রকাশ পেয়েছে।
প্রেমের সঙ্গে বিচ্ছেদ বেদনার একটি নিবিড় যোগ আছে। প্রেমের সঙ্গে বিশ্বাস ভঙ্গের জ্বালাও হৃদয়কে ব্যথিত করে তোলে। আর সেই সঙ্গে অতীত দিনের সুখ স্মৃতি হৃদয়কে বিদ্ধ করে। ‘শাশ্বতী’ কবিতাটিতে বেদনা আছে, আছে হাহাকার। কিন্তু সেই সঙ্গে ঘোষিত হয়েছে প্রেমের শাশ্বত মূল্যবোধ। একদিন ‘বাদল শেষের রাতে’ কবি-প্রিয়া হাত রেখেছিল তার হাতে। আর ‘চেয়েছিল মুখে সহজিয়া অনুরাগে।’ সেদিন প্রকৃতির কোমল ও মধুর স্পর্শ কবি হৃদয়কে উদ্বেলিত করেছিল। কবি সেই রোমাঞ্চকর অনুভূতি প্রকাশ করেছেন অনবদ্য ভাষায় —
একটি কথার দ্বিধা থরথর চূড়ে
ভর করেছিল সাতটি অমরাবতী;
একটি নিমেষ দাঁড়াল সরণী জুড়ে
থামিল কালের চিরচঞ্চল গতি...
এই ক্ষণকালের অনুভব সামান্য নয়। প্রবল আবেগে আলোড়িত হয় হৃদয়। কবির সেই প্রলয়ঙ্করী অনুভব বাঁধা পড়ে দুটি ছত্রে—
একটি স্মৃতির মানুষী দুর্বলতা
প্রলয়ের পথ ছেড়ে দিল অকাতরে।
আজও গভীর আবেগে কবি অন্তরে সেই ব্যাকুলতাটিকেই সযত্নে লালন করেছেন। প্রিয়তমকে আবার কাছে পাবার বাসনা। কিন্তু ‘সে আজ আর কারে ভালোবাসে’। কবি তাঁর প্রিয়তমের বিরহ বেদনায় জর্জরিত। কিন্তু স্মৃতি তো বিশ্বাসঘাতকতা করে না। প্রকৃতির মাদকতাময় প্রতিবেশে কবি অনুভব করেন—
স্মৃতি পিপীলিকা তাই পুঞ্জিত করে
আমার রন্ধ্রে মৃত মাধুরীর কণা
সে ভুলে ভুলুক, কোটি মন্বন্তরে
আমি ভুলিব না, আমি কভু ভুলিব না।
কবিতাটিতে বিরহ বেদনার সকরুণ ব্যাকুলতা প্রকাশ পেয়েছে। আর সেই সঙ্গে কবি প্রেমের শাশ্বত মূল্যকে গৌরবান্বিত করেছেন। যথার্থ প্রেম কেবলমাত্র দেহ নির্ভর, সন্দসুখ নির্ভর নয়। শাশ্বত প্ৰেম অনন্তকাল স্মৃতিময় হয়ে হৃদয়ে জাগ্রত থাকে।
রোমান্টিক প্রেমানুভূতির সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক অতিনিবিড়। প্রকৃতির মাধুর্যের মধ্যেই হৃদয়ে প্রেমের শতদলটি বিকশিত হয়। সুধীন্দ্রনাথ শাশ্বতী কবিতায় এত অপূর্ব মাধুর্যময় প্রকৃতির রূপ বর্ণনা করেছেন। কবিতাটির ছত্রে ছত্রে মাদকতাময় প্রকৃতির উচ্ছ্বাস অঙ্কিত হয়েছে।
শ্রান্ত বর্ষার অবসাদে পৃথিবীর বুকে শ্যামল ছায়া। তার মধ্যে পলাতক আলোছায়ার খেলা। শরতের মৃদঙ্গ বাতাসে তুলেছে প্রতিধ্বনি। আকাশে বাতাসে আগমনীর পদধ্বনি। দীর্ঘদিনে কুহেলীময় শীতের জড়তা দূর হয়ে চোখ মেলবে শতদল, ঝরে পড়বে শেফালী। প্রকৃতির এই উন্মনা প্রতিবেশে জেগে উঠেছে অতীত দিনের স্মৃতি। এমনই এক বাদল রাতের শেষে কবি প্রিয়া হাত রেখেছিল কবির হাতে। সে যেত শত জনমের অতীত স্মৃতি। সেদিন গভীর অনুরাগে সুখ তুলে চেয়েছিল তাঁর প্রিয়া। সে সবই কবির কাছে আজ স্মৃতি মাত্র। এক অসাধারণ প্রাপ্তি সেদিন ঘটেছিল কবির ভাগ্যে। অনাদি কালের সব চাওয়া-পাওয়ার অবসান ঘটেছিল সেদিন। একটি কথাই এনে দিয়েছিল সাতটি অমরাবতীর অনুভব। কবির এই মানুষী-দুর্বলতা হৃদয়কে ধ্রুবতারার স্নিগ্ধতায় ভরে দিল। এ যেন এক প্রলয়ের ব্যাকুলতা।
আজ আবার কবি মনে ঢেউ জেগেছে। প্রিয়ার দেহ সৌরভ তাঁকে উন্মনা করেছে। ভরা নদী যেমন ছুটে যায় সাগরের দিকে তেমনি ব্যাকুল আহ্বান অনুভব করেন কবি। কবি প্রিয়ার স্বপ্নালু নীল চোখের রোমরাজিতে ঘাসের কোমলতা।
কবির প্রিয়তমা আজ অন্য কাউকে ভালোবাসে। কিন্তু কবির মনে স্মৃতির পিপীলিকাগুলি সঞ্চয় করে রেখেছে মাধুরীর কণা। তাই কবির প্রত্যয় সে ভুললেও তাকে ভুলবেন না কবি। কবিতাটির শেষ ছত্রে কবির অন্তরের আবেগ আর্তনাদের মতো ধ্বনিত হয়ে ওঠে— ‘আমি ভুলিব না, আমি কভু ভুলব না।’
প্রকৃতির সঙ্গে মানব হৃদয়ের বন্ধনটি অতি নিবিড়। তাই ঋতু বৈচিত্র্যের মধ্যেই স্মৃতির বেদনা প্রবল ও ব্যাকুল হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ তাই বলেছেন—
“আমি সেই চির-দিবসের প্রেম অবসান লভিয়াছে,
রাশি রাশি হয়ে তোমার পায়ের কাছে।
নিখিলের সুখ, নিখিলের দুখ, নিখিল প্রাণের প্রীতি,
একটি প্রেমের প্রসারে মিশেছে সকল প্রেমের স্মৃতি—
সকল কালের সকল কবির গীতি।” (অনন্ত প্রেম—মানসী)
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আরো নোট পেতে সাহিত্য বাংলা WhatsApp Group-এ যুক্ত হন

